কত ঘর ভাঙল, কত মানুষ ফিরল না! সুন্দরবন জুড়ে আয়লার স্মৃতি আর বুলবুলের ক্ষতি
রুবি শেখ (সুন্দরবন)

“আয়লা’তেনে তো সব গিললো, এবার বুলবুলির পালা…”
চমকে উঠলামl ঘরের ভিতর থেকে ককিয়ে ওঠা এই হাহাকার যেন চিড় ধরাল কানের পর্দায়। কয়েক দিন আগে থেকেই নানা জায়গা থেকে জানতে পারছি, বুলবুল নামের এক বিধ্বংসী ঝড় ধেয়ে আসছে আমাদের দক্ষিণ-বাংলার বুকে। যার প্রবল নিষ্ঠুর দাপটে হয়তো আরও একবার তছনছ হতে চলেছে আমাদের গর্ব, প্রকৃতির অপার রহস্যে মোড়া আমার জন্মস্থান, সুন্দরবন।
বুকটা কেঁপে উঠল, ওই অচেনা একচালা মাটির বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। গ্রামের অন্দরে এসেছিলাম, কিছু স্থানীয় মানুষের সঙ্গে দেখা করার কাজে। সুন্দরবনের মেয়ে আমি। বনবাদাড়ে ভয় পাই না। বরং পেশায় আর নেশায় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানোই কাজ। শনিবারও তাই ছিল। ঠান্ডা ঠান্ডা সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম। জলতেষ্টা পেতে ওই বাড়ির দাওয়ায় উঁকিঝুঁকি।
কিন্তু ওই কান্না শুনে জল চাইব কী, তখন জল চাওয়ার মতোও আওয়াজ বেরোচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঢোঁক গেলার চেষ্টা করলাম বেশ কয়েকবার। হাহাকার তখনও থামেনি। মনে পড়ল, আয়লার দশ বছর পূর্ণ হয়েছে এই ক’দিন আগে। সেই তীব্র ধ্বংসলীলার পরেও, জলে-জঙ্গলে খেটে খাওয়া গরিবগুর্বো মানুষগুলো সব হারিয়েও, অসম-কঠিন লড়াইয়ে বেঁচে আছে এখনও। শুধু মুখে মুখে ফেরে আজও আয়লার কথা। সচেতন ভাবে নয়, অজান্তেই যেন দিনযাপনের আয়না হয়ে উঠেছে আয়লা। “যে বছর আয়লা হল, সে বছরেই জন্ম আমার ছেলেটার।” অথবা, “আয়লার পরের বছরেই তো ওর বাপটাকে নিয়ে গেল বাঘে।”
ভাল নাকি খারাপ? জীবনযাপনের গায়ে আয়লার ক্ষত জড়িয়ে এই বেঁচে যাওয়া ঠিক কেমন? সে খবর আমরা কোথায় আর রাখি! কেবল সিঁদুরে মেঘ দেখলে, ফের জেগে ওঠে আমাদের ঘর পোড়ার ভয়।
হাহাকার করা কণ্ঠের মালকিনের সঙ্গে দেখা হয় এক সময়ে। ফাটা ঠোঁট, রুক্ষ চুলl অভাবে আর অযত্নে কাঠ হয়ে যাওয়া একটা শরীরের কাঠামো যেন। কাঁচা-পাকা চুলে ঢাকা মাথার মাঝে যদিও বিয়ের গাঢ় চিহ্ন। ক’দিন ধরে নদীঘাটের দিকে ক্ষণে ক্ষণে ঘুরে আসা কাজ হয়েছে তাঁর। সেখানেই নৌকো করে ফিরে আসবে ঘরের মানুষl নৌকোভর্তি উপার্জন। কিন্তু মানুষটা কি আদৌ ফিরবে! মাছ-কাঁকড়ার জগতে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ গত পাঁচ দিন। আর তার মধ্যেই তো এই বুলবুল না কী যেন… যদি ডিঙিটা তলিয়ে দেয় নিকষ কালো অন্ধকার অতলে!
আমি পালিয়ে বাঁচি। সুন্দরবনের গভীরে হলেও, আমার পাকা ঘরের জীবন। জল-জঙ্গলে মানুষ হলেও আমার ঘরের বাবা-দাদাকে নৌকো নিয়ে গহিন জলে যেতে হয় না এত কঠিন পরিস্থিতিতে। তাই এই অপার উদ্বেগের ভাগ নেওয়া কি আমায় মানায়!
তবু মেসেজ করি, সুন্দরবন রিজ়ার্ভ ফরেস্টের পরিচিত এক গাইড বন্ধুকে। জিজ্ঞেস করি, ‘অনির্বাণবাবু, আপনার গ্রাম কেমন আছে? ঝড় নিয়ে নিশ্চয়ই খুব চিন্তায়!’ জানতাম, মেসেজ হয়তো সহজে যাবে না। গোটা সুন্দরবন জুড়েই নেটওয়ার্কের প্রবল সমস্যা শুরু হয়ে গেছে। উত্তর আসে খানিক পরে। ‘বেশিরভাগ তো মাটির বাড়ি, ভয়টা সেখানেইl তেমন ঝড় সামাল দিতে পারবে না। সাধারণ মানুষ আতঙ্কে ভুগছে, বড্ড দিশাহারা। জানি না, ভাগ্যে কী আছে…’
এই সময়গুলোয় আমরা খুব অসহায়। প্রকৃতি আমাদের ভরিয়ে দিয়েছে। আগলে রেখেছে। আমারা সুন্দরবনের প্রতিটি মানুষ জলের কাছে, জঙ্গলের কাছে ঋণী। ঈশ্বর মানি আমরা প্রকৃতিকে। বাঘের নামও নিই না, বনবিবি বলি তাকে। হাজার লোকাচার আর সংস্কারে তুষ্ট করার চেষ্টা করি প্রকৃতিকে। কিন্তু তার পরেও এই প্রকৃতিই যদি রুষ্ট হয়, আমাদের শত আর্তিও তার কানে পৌঁছয় না। শত প্রার্থনা অগ্রাহ্য করে আমাদের একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই প্রকৃতি। সত্যিই যদি তেমন হয় আবার, এই এত এত মানুষ!
আসলে, সুন্দরবনের ভিতরে থেকে আমরা যে এই ক’টা দিন কী কাটিয়েছি, তা বোধহয় কিছুতেই বোঝানো সম্ভব নয় বাইরের দুনিয়ার মানুষকে। বাইরের কাছে যেটা একটা খবর, যেটা খতিয়ান, আমাদের কাছে সেটাই অপূরণীয় ক্ষতি। যে কোনও দুর্যোগই বাইরে থেকে দেখা, শোনা, জানা এক রকম। কিন্তু ভিতর থেকে অনুভব করা, আশপাশের মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আতঙ্কের সঙ্গী হওয়া, চরম উদ্বেগে এক একটা পল-অণুপল কাটানো– সেটা যে কতটা কঠিন!
অবসরের সঙ্গী ফেসবুক। রাতে ঘরে ফিরে চোখ রাখি সেখানেই। হয়তো মনটাকে একটু হাল্কা করতে। কলজে কেঁপে যায় নিউজ়ফিডে কিছু খবর চোখে পড়তেই। “শনিবার সন্ধের মধ্যেই সাগরদ্বীপে আছড়ে পড়তে চলেছে আয়লার থেকেও শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। আবহাওয়াবিদদের মতে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবন অঞ্চল।”– পরিবেশন ভিন্ন হলেও, সব খবরের বয়ান মোটামুটি একই।
আগেই বলেছি, জন্ম আমার এই সুন্দরবনের মাটিতেই। বড়ও হয়েছি এখানেই। আয়লার সময়ে আমিতখন কিশোরী। প্রকৃতির ভয়ঙ্কর সেই রূপ আজও চোখের সামনে ভাসে। অনাহারের সাক্ষী হয়েছিলাম। সাক্ষী হয়েছিলাম এক গ্লাস পানীয় জলের জন্য হাহাকারের। চোখের সামনে দেখেছিলাম, এক টুকরো খাবার কেড়ে খাওয়ার জন্য আশপাশের চেনা মানুষজনই কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছিল! নোংরা হাঁটুজলে ভেসে গেছিল লাশ। পচা গন্ধে ভারী হয়েছিল বাতাস। শ্বাস রোধ করে দেখেছিলাম, সবুজ-সতেজ জলেঘেরা একটা বনজীবন কেমন দুমড়ে পড়ল। এখন বয়স বেড়েছে, ধার বেড়েছে অনুভূতির। দায়িত্ব বেড়েছে সুন্দরবনের প্রতি, বেড়েছে ভালবাসাও। কিশোরীবেলার সেই দুঃসহ দিন কি আবারও ফিরবে!
“আজা, নাচ মেরি বুলবুল”, “আরে ভাই, বুলবুল আসছে, এই তো রোমান্টিক ওয়েদার প্রেম করার”, “বুলবুল তুমি কখন আসবে? আর কত অপেক্ষা করাবে এই প্রিয়তমাকে?”― স্টেটাসময় ফেসবুক। হাজারো পদ্য, শত শত জোক্স। কত রকমের খিচুড়ির ছবি পেরিয়ে যায় স্ক্রল করতে করতে। সব শূন্য লাগে চোখের সামনে। এক এক সময়ে মনে হয়, দৌড়ে যাই, নিয়ে আসি সেই মানুষগুলোকে, যাঁরা শহরের পাকাবাড়িতে বসে একটা বিধ্বংসী ঝড়কে নিজেদের বিনোদনের জন্য আহ্বান করছেন ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে। মনে হয়, তাদের টেনে এনে বসিয়ে দিই নদী উপকূলবর্তী কোনও এক মাটির একচালা ঘরে। তার পর আসুক তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত ঝড়!
শুভবুদ্ধি বাধা দেয়। মনে করিয়ে দেয়, যে ক্ষতি সুন্দরবন দেখেছে, তা যেন শত্রুও না দেখে! আর এরা তো অজ্ঞতার বশে এটা করছে। পরিস্থিতির সম্যক ধারণা না পেয়ে এমন বলছে। বাইরে থেকে ভিতরের কিছু বোঝা যায় না বলেই এসব লিখছে। সুন্দরবনকে নিয়ে আমার আবেগ, আমাদের আশঙ্কা– তা আর পাঁচ জনের সঙ্গে মিলবে কেমন করে!
কেবল বুক কাঁপে আমাদের। শনিবার সন্ধের পরেই খবর আসে, বুলবুল সাগরদ্বীপে আছড়ে পড়ছে। আর দেরি নেই এখানে পৌঁছতে। জানি না, ঠিক কী হতে চলেছে। নিরুপায় হয়ে বসে থাকি পরিবার-প্রতিবেশীদের আঁকড়ে। মনের মধ্যে তোলপাড়। চোখে ভাসছে নদীঘেঁষা মানুষগুলোর চিন্তাক্লিষ্ট, ভীতু মুখ।
তবে সরকারি তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন এলাকার বহু মানুষজনকে সরানোর খবর আসছিল শুক্রবার থেকেই। অনেককেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে। প্রাণে বেঁচে যাবে বহু মানুষ। কিন্তু ঝড় থামলে, প্রকৃতি শান্ত হলে, যখন দীর্ঘদিনের চেনা উঠোনে ফিরবে তারা, তখন? যদি দেখে ঘরটা মিশে গেছে মাটিতে, অথবা বাঁধ ভাঙা নোনাজলের তীব্র আক্রোশে সবটা ধুয়ে-মুছে কেবল একরাশ শূন্যতা রয়ে গেছে বাস্তুভিটের কঙ্কালসার কাঠামো জুড়ে!
শনিবার সারারাত দু’চোখের পাতা এক হয় না। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই একেবারেই। বিদ্যুৎও নেই বিকেল থেকেই। ঝড়ের দাপট বাড়তে বাড়তে একসময় মনে হয়, পাকা বাড়িরও ভিত কাঁপছে। বুলবুল কি এসে গেল? বাড়িটা কি ভেঙে পড়বে? গাছপালা ভাঙছে আশপাশে। চড়চড় আওয়াজ থেকে থেকে। সুন্দরবন কি আবার শেষ হয়ে যাবে!
আমার বাবা অবশ্য আগেই বলেছিল, এখন মরানির কোটাল। জলস্ফীতি কম থাকবে। নদীবাঁধ ভাঙার সম্ভাবনাও কম। এবার হয়তো বেঁচে যাবে আমাদের সুন্দরবন। সে কথাই ভাবি জোরে জোরে। জপ করি যেন। ভরসা পাই। হাতের মুঠো শক্ত হয়। বন্ধ চোখে দাঁতে দাঁত চেপে বলি, ভালো থেকো সুন্দরবনl বেঁচে যেও। জিতে যেও।
রবিবার সকালে রোদ উঠেছে। ঝড়ের চিহ্ন নেই। কিন্তু সুন্দরবন বেঁচে গেলেও, ভাল থাকেনি। জিততে তো পারেইনি। রাতভর প্রকৃতির রোষে উপকূলবর্তী জন-জীবন তুমুল ক্ষতিগ্রস্ত। চিড় ধরেছে একাধিক নদীবাঁধে। মানুষ দিশাহারা। কয়েকটি মৃত্যুর খবর এসেছে আশপাশের গ্রাম থেকে। বহু মাটির চালা ভেঙে গিয়েছে আমাদের বাড়ির আশপাশেই। তবে সরকারি তৎপরতায় অনেক জীবন বেঁচেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তুলনামূলক ভাবে কম।
কিন্তু যাদের প্রাণ বাঁচলেও ঘর হারাল! আজ তো না হয় ত্রাণশিবিরে দিন কেটে যাচ্ছে… কিন্তু কাল! পরশু? তারপরের দিনগুলো? প্রশ্নগুলো জলে-জঙ্গলে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে নিজের কাছে। শুধু ঘরই বা বলি কেন? মাঠভরা ধানও তো পাকার সময় হয়ে গেছিল। শীত পড়ছিল, নবান্নের পরব এগিয়ে আসছিল। ফসলভরা সে সব সোনার জমি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে একরাতে। কত কত চাষিভাইয়ের সারা বছরের পরিশ্রম একেবারে শেষ হয়ে গেল। ওদিকে কত কত হাঁস-মুরগি-ছাগল যে মারা গেছে, তারও হিসেব নেই। বুলবুলের আগে জঙ্গলে যাওয়া যে মানুষগুলো এখনও নিখোঁজ, তাদের ফেরা না হলে কি বলা যায়, বিপদ কেটেছে? ক্ষতির পরিমাণ কি নিশ্চিত করা যায়?
বিপদ, ক্ষতি, যন্ত্রণা– এসব কি আর কেবলই এক রকম? এক একটা বিপদ আসে সুন্দরবনের উপরে, আর কত-শত ক্ষতি মিশে তৈরি হয় আমার যন্ত্রণাময় দ্বীপের উপাখ্যান!
দি ওয়ালের সৌজন্যে