বছরজুড়েই একের পর এক ইস্যু
একের পর এক ইস্যুতে প্রায় সময়ই দিশেহারা হয়ে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। আর এসব ইস্যুতে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্টদের। একটা শেষ হতে না হতেই আসে আরেকটি।
নতুন ইস্যু আসার পর ঢাকা পড়ে আগেরটা। আবার কখনও একই সময়ে একাধিক ইস্যু উপস্থিত হয়ে টালমাটাল করে দিচ্ছে গোটা পরিস্থিতি। বছরজুড়ে মনুষ্য সৃষ্ট এগুলোর মেয়াদ কোনটা তিন দিন, কোনটা সাত দিন, এমনকি কোনটি ১৫ দিন পর্যন্তও স্থায়ী হয়। এ যেন ‘১২ মাসে ১৩ পার্বণের’ মতো অবস্থা।
পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমূল্যের ক্ষত শোকাতে না শোকাতেই মঙ্গলবার সারা দেশে শুরু হয়েছে লবণ ইস্যু। বাজারে লবণ নেই- এমন গুজব ছড়িয়ে সারা দেশে এ নিত্যপণ্যটি নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায়। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে অরাজকতা। সারা দেশে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চলছে পরিবহন ধর্মঘট।
এসবের পাশাপাশি বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা, ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুশরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারা, বরগুনায় রিফাত ফরাজীকে কুপিয়ে হত্যা, ক্যাসিনোবিরোধীসহ আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান, চকবাজার ও বনানীর এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, কসবার মন্দবাগ স্টেশনে দুই ট্রেনের সংঘর্ষসহ এক ডজনের বেশি ইস্যু।
চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের প্রধান খবর, টকশো এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও স্থান করে নিয়েছে এসব ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন নতুন ইস্যু নিয়ে রীতিমতো ঝড় বইয়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সরকারকে বিব্রত বা বেকায়দায় ফেলতে একটি মহল সক্রিয় রয়েছে। তারা নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করছে। কিন্তু এসব ইস্যু শক্ত হাতে মোকাবেলায় সরকার অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে গাফিলতি রয়েছে। তখন মনে হয়, দেশে কোনো শাসন নেই।
তিনি বলেন, সরকার কঠোর হলে অনেক কিছুই সম্ভব। সর্বশেষ লবণ ইস্যুতে বোঝা গেল সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এসব ইস্যু মোকাবেলা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সরকারের পলিসিতে ভুল ছিল। কারণ এই পণ্যটির নতুন করে চাহিদা তৈরি হয়নি। চাহিদা আগেও যা ছিল, এখনও আছে। সরবরাহে সমস্যা ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকে যে আগ্রাসীভাবে আমদানি করা হচ্ছে, এটি আগে করা হলে সংকট তৈরি হতো না। সমস্যা আমাদের পলিসি প্রতিক্রিয়াশীল। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে উদ্যোগ নেয়া হয়।
তিনি বলেন, লবণের বিষয়টি হল গুজবভিত্তিক সংকট। এই সংকটের ফলে ক্রেতারা অতিরিক্ত মজুদ করে। এতে দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একে বলে প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ ধারণা করেছি, দাম বাড়বে। বাস্তবেও তাই হয়। সবকিছু মিলে আমি বলব, বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা আছে।
৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ বছরের শুরুতেই টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। কিন্তু একটা পর একটা ইস্যুতে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে কাজের স্বাভাবিক গতিও। সর্বশেষ পেঁয়াজ নিয়ে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি সম্মুখীন হতে হয়েছে সরকারকে। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে বিপদে আছি।’
সেপ্টেম্বর থেকে নতুন ইস্যু পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি। ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পরই আলোচনায় আসে এ পণ্যটি। সরবরাহ কমের অজুহাত দেখিয়ে প্রতিদিনই বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। এক পর্যায়ে তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে কেজি বিক্রি হয় ২৫০ টাকার বেশি দরে। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ইস্যুটি সর্বত্রই আলোচনায় স্থান পায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে রীতিমতো ঝড় ওঠে। এমনকি বিয়ে বাড়িতে পেঁয়াজ উপহার দেয়ার ঘটনাও ঘটে। মিসর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আনার ঘোষণা এবং দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসায় বর্তমানে কমতে শুরু করেছে এ পণ্যটির দাম।
পেঁয়াজ ইস্যু কাটতে না কাটতেই চলে আসে লবণ ইস্যু। মঙ্গলবার সকাল থেকে বাজারে লবণ নেই- এমন গুজব ছড়িয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। গুজবে কান দিয়ে সারা দেশের মানুষ লবণ কিনতে দোকানে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। লবণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে- সরকারের এমন কথাও যেন তারা বিশ্বাস রাখতে পারছেন না।
তবে পেঁয়াজ কেলেঙ্কারির পর লবণ ইস্যুতে সরকারকে বেশ সক্রিয় দেখা গেছে। গুজব ছড়িয়ে যাতে কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অতিরিক্ত দামে যারাই লবণ বিক্রি করেছে জরিমানার সঙ্গে সঙ্গে কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছে। শুধু বিক্রেতা নয়, ক্রেতারাও রক্ষা পায়নি।
পেঁয়াজ ও লবণ ইস্যুর মধ্যেই চলছে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরকে কেন্দ্র করে পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘট। এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের অনেক জেলায় পরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ যাত্রীরা।
বুধবার থেকে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে। সব মিলিয়ে সড়ক-মহাসড়কে চলছে এক রকম নৈরাজ্য। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এমন পরিস্থিতি আর কয়েকদিন অব্যাহত থাকলে নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্টদের।
এ বছরের শুরুতে ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জন নিহত হন। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ফের আলোচনায় আসে পুরনো ঢাকার রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা। এর আগে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানি হওয়ার পর রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানাগুলো সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ফলে ফের চুরিহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সবার টনক নড়ে। বেশ কয়েকদিন আলোচনায় থাকে পুরান ঢাকার এ দুর্ঘটনা।
চুরিহাট্টার ক্ষত শোকাতে না শোকাতেই বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২৮ মার্চের ওই আগুনে ২৬ জন নিহত হয়। সারা দেশেই তখন আলোচনায় ছিল এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড। পরের মাসে গুলশান ডিসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বলতে গেলে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ এ দুই মাস অগ্নিকাণ্ডের ইস্যুই ছিল দেশের মূল আলোচনা।
অগ্নিকাণ্ডের ইস্যু যখন ভুলতে বসেছে ঠিক সেই সময়েই নতুন ইস্যু ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুশরাত জাহান রাফিকে পুুড়িয়ে মারা। ৬ এপ্রিল তার গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৯ এপ্রিল মারা যান রাফি। রাফিকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
এ ইস্যুতে উত্তাল হয়ে পড়ে পুরো দেশ। দোষীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন অনেকে। গুরুত্বপূর্ণ এ ইস্যুতে সরকারও নড়েচড়ে বসে। দোষীদের গ্রেফতার করে। সম্প্রতি এ মামলায় সব আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
রাফিকে পুড়িয়ে মারার ইস্যু শেষ হতে না হতেই বরগুনায় ঘটে পৈশাচিক ঘটনা। ২৬ জুন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে তার স্বামী রিফাত শরীফকে হত্যা করে। নির্মম হত্যাকাণ্ডের এ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। চায়ের টেবিলসহ রাজনৈতিক অঙ্গন সর্বত্রই আলোচনায় ছিল বরগুনার এ হত্যাকাণ্ড। এ ছাড়া এ বছরের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান।
চাঁদাবাজ ও বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে এক প্রকার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে নামে সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। চুনোপুঁটি থেকে শুরু করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের মতো রাঘববোয়ালরাও এ অভিযান থেকে রক্ষা পায়নি।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান দেশে-বিদেশে সর্বত্র আলোচনায় স্থান পায়। এ অভিযানের পাশাপাশি আওয়ামী লীগে চলে শুদ্ধি অভিযান। চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদ হারাতে হয়। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদকও অনেকের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। তাদের ব্যাংক হিসাব তলবসহ এনবিআর অনেকের হিসাব বন্ধ করে দেয়।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যেই নতুন ইস্যু হয়ে সামনে আসে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা। ৭ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে খুন করে আবরারকে। আবরার হত্যায় ভিডিও প্রকাশের পর তা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। খুনিদের গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানানো হয় বিভিন্ন সংগঠন থেকে। অবশেষে বুয়েটে সংগঠনভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
এ মাসের ১২ তারিখে কসবার মন্দবাগ স্টেশনে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। দুই ট্রেনের সংঘর্ষের এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১৮ জন। কসবার ঘটনার একদিন পরই সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ঘটে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। এতে প্রাণহানি না হলেও তিনটি বগি পুড়ে যায়। পরপর দুটি ঘটনায় ট্রেন ইস্যুটি আলোচনায় আসে। যদিও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।