বট-পাকুড়ের বিয়ের দাওয়াত খেলো গ্রামবাসী
বট আর পাকুড় গাছের ব্যতিক্রমধর্মী বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বিয়ের আয়োজনে কোন কমতি ছিল না। তিন দিন ধরে চলছে বিয়ের অনুষ্ঠানিকতা। গাছের চারপাশে সাজানো হয়েছে। বিয়েতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে আত্মীয় স্বজন ও গ্রামের শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুদের। এ ব্যতিক্রমী বিয়ের আয়োজন করা হয় চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার ডাউকি ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামের দরগগাতলা পাড়ায়।
জানা যায়, প্রায় ১ বছর আগে বিনোদপুর গ্রামের দরগাতলাপাড়ার নবীছদ্দিন বিশ্বাসের স্ত্রী মোমেনা খাতুন স্বপ্নে দেখেন বাড়ির পাশে বট ও পাকুর গাছ দুটি বড় হয়েছে। গাছ দুটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু নবীছদ্দিন একজন দরিদ্র মানুষ হওয়ায় তার পক্ষে বিয়ের আয়োজন করার সামর্থ ছিল না।
বিষয়টি মোমেনা খাতুন তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের জানায়। তখন সবাই আলোচনা করে বিয়ের দিন ঠিক করে। বিয়ের আয়োজনের জন্য টাকাও তোলা হয়। বিয়ের জন্য সকল কেনা কাটা করা হয়। ছেলে-মেয়ের শাড়ি, লুঙ্গি, সাজ সোজ্জার উপকরণ, বাজারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হয়।
বিয়ের মূল অনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় মঙ্গলবার দুপুর থেকে। প্রথমে বট ও পাকুড় গাছ দুটি কে হলুদ মাখানো ও গোসল করানো হয়। বুধবার খির খাওয়ার আয়োজন করা হয়। খির খাওয়ার অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হয় নিকট আত্মীয় স্বজন ও গ্রামের সাধারণ মানুষদের। খির খাওয়ানোর অনুষ্ঠান চলে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয় বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা। সকাল থেকে বাড়িতে বাজতে শুরু করে গানবাজনা। আর ঢোল বাঁশির তালেতালে শুরু হয় নাচ ও গান। উল্লাস ও আনন্দে মেতে উঠে সব বয়সের মানুষ। বিয়ে বাড়িতে মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে। দুর দুরন্ত থেকে ছুটে আসে বিয়ে দেখতে সাধারণ মানুষ।
সকাল থেকে শুরু হয় রান্নার আয়োজন। একটি ছাগল জবাই করা হয়। দুপুরের আগেই শেষ হয় রান্না। বিয়েতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে আত্নীয় স্বজন ও গ্রামের শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুদের।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে শুরু হয় বিয়ের আয়োজন। বট গাছকে পুরুষ ও পাকুড় গাছকে নারী হিসাবে ধরা হয়। গাছের চার পাশ রঙিন কাগজ, ফুল দিয়ে সাজানো ও ছামিয়ানা টানানো হয়। বট গাছে লুঙ্গি পড়ানো হয়। আর পাকুড় গাছে শাড়ি পড়ানো হয়। ধুপ, আগরবাতি মোমবাতি জ্বালানো হয়। গাছের গোড়ায় রাখা হয় বিভিন্ন ফল।
আনুষ্ঠানিক ভাবে বট ও পাকুড় গাছের মধ্যে বিয়ে পড়ান একই গ্রামের মানোয়ার হোসেন। মানোয়ার হোসেন নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে বলেন গাছের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তারা আজ থেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হর।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দুপুরে শতাধিক নারী-পুরুষদের খাবর দেওয়া হয়। অতিথিদের খাওয়ানো হয় খাসির মাংস, সাদা ভাত, মুসুর ডাল, সবজি ও মুরগির মাংস। খাওয়ায় ছিল না কোন কমতি। তাই সবাই পেট পুরে খেয়েছে।
নবীছদ্দিন বিশ্বাস বলেন, বাড়িতে দুটি গাছ আছে। আমার স্ত্রীর স্বপ্ন দেখে যে গাছ দুটির মধ্যে বিয়ে দিতে হবে। তাই এ বিয়ের আয়োজন। সবাই মিলে বিয়ের আয়োজন শেষ করতে পেরেছি।
মোমেনা খাতুন জানান, আমি এক বছর আগে স্বপ্ন দেখি গাছ দুটিকে বিয়ে দিতে হবে। প্রথমে বিষয়টি কাউকে না জানালেও পরে বিষয়টি অনেক কে জানায়। বাড়ির পাশে একটি খেজুর গাছ ছিল। সেই খেজুর গাছের মধ্যে বট ও পাকুড় গাছ জন্ম নেয়। পরে খেজুর গাছটি মারা যায়। বিয়ের আয়োজনে কোন কমতি রাখা হয়নি।
বিনোদপুর গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন খোকন জানান, আমি একজন বাঁশি বাদক। অনেক জায়গায় অনুষ্ঠানে গিয়েছে কিন্তু এমন বিয়ে প্রথম দেখলাম। মোমেনা খালা বিয়ের দাওয়াত দিলে আমি বিয়েতে আসি। খাওয়া দাওয়া করেছি এখানে আমরা গ্রামের সবাই।
জরিনা খাতুন নামের বৃদ্ধা বলেন, বয়স অনেক হলেও এমন বিয়ের দেখিনি কখনও। সখ করে বিয়ের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠান দেখে খুব ভাল লাগল।
মানোয়ার হোসেন বলেন, আমি একটি ব্যতিক্রমধর্মী বিয়ে পড়ালাম। বিয়েতে সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিছু নিয়ম কানুন মেনে বিয়ে পড়ানো হয়েছে।
আলমডাঙ্গা ডাউকি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার বদর উদ্দিন জানান, প্রথমে আমি মনে করি নবীছদ্দিন বিশ্বাসের নাতী ছেলের বিয়ে হচ্ছে। কারণ বাড়িতে গান বাজনা, আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল বড় আয়োজন করে বিয়ে হচ্ছে। পরে জানতে পারি যে বট ও পাকুড় গাছের বিয়ে হয়েছে।
আলমডাঙ্গা সরকারী ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কৃষিবিদ গোলাম সরোয়ার বলেন, গাছের বিয়ের বিষয়টি আমি শুনেছি। বিয়েতে আয়োজন ছিল অনেক। কোন কিছুর কমতি ছিলনা। এ ধরনের বিয়ের আয়োজনের কথা প্রথম শুনলাম। গ্রামের মানুষ কুসংস্কার থেকে এ ধরনের আয়োজন করেছে। কারণ তারা শিক্ষিত নয়।
আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামি গ্রামের মওলানা নাসির উদ্দিন বলেন, ধর্মের উপর বিশ্বাস না থাকার কারণে এ বিয়ের আয়োজন করেছে। ইসলাম ধর্মে যার কোন বিধান নায়। কুসংস্কার থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।