কলকাতায় ভাল আছেন ওঁরা, তবু মন পড়ে আছে কাশ্মীরে
মেলায় স্টলে বসে ক্রেতা সামলাচ্ছেন, কিন্তু ইনসার আহমেদের মন পড়ে রয়েছে কাশ্মীরে।
সন্ধের দিকে। করুণাময়ীর বিধাননগর মেলা তখন জমে উঠেছে। কেমন আছে কাশ্মীর, জানতে চাওয়ায় ইনসার বললেন, ‘আমরা শান্তি চাই। বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে বেঁচে আছি। অনেক কিছুই দেখেছি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। এরপর কী হবে, ভাবলেই ভয় হচ্ছে।’
বাদগামের যে গাঁয়ের মেয়ে–বউরা সালোয়ার স্যুট, শাল ও কার্পেটের গায়ে নকশা ফুটিয়ে তোলেন, শাল বিক্রেতা ইনসার সেখানকারই বাসিন্দা। মেলায় তাঁর স্টল কাশ্মীর আর্ট এম্পোরিয়ামে বসে ইনসার জানালেন, তাঁর পরিবারের লোকজনও নকশার কাজের সঙ্গে যুক্ত। তিনি এই মেলায় আসছেন গত দশ বছর ধরে। কলকাতা এলে ওঠেন সায়েন্স সিটির কাছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। দেশের বহু শহরে গেছেন।
কিন্তু কলকাতাই তাঁর সবথেকে প্রিয়। এখানকার লোকজনও তাঁর ‘বড়িয়া’ লাগে। তবে এ বছর শাল বিক্রি কম। এরজন্য গাড্ডায় পড়া অর্থনীতিকেই দায়ী করলেন তিনি। বললেন, ‘পশমিনা’–সহ কাশ্মীরি পোশাকের বেশ দাম। নকশার প্রকারভেদে প্রায় ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে, শখের জিনিস কিনবে কী করে?
কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা তুলে নেওয়ার পর এখন সেখানে কী ঘটছে? কেন জনজীবন, যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও স্বাভাবিক হয়নি? প্রশ্ন শুনে কিছুটা ভাবলেশহীন হয়ে পড়লেন এনএএল এমব্রয়ডারি–র ইকবাল জারগার। বললেন, ‘সরকার তো বলেছিল, ভালর জন্যই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভাল হচ্ছে কই? কাশ্মীরের ব্যবসা–বাণিজ্যের অবস্থা তো খুবই খারাপ। কর্মসংস্থানও দিন–দিন কমছে।’
ইকবাল শ্রীনগরের বাসিন্দা। তাঁর মতে ভারতের অন্য সব শহরের তুলনায় কলকাতা নিরাপদ। ১৪ বছর ধরে বহু কাশ্মীরির মতো তিনিও কলকাতায় আসেন। শহরের বিভিন্ন মেলায় স্টল খোলেন। এখানে ভাল ব্যবসা হয়। তাঁর পরিচিতি ভাই–বেরাদররা কলকাতা এলে ডেরা বাঁধেন তালতলা–রিপন স্ট্রিটের পাঁচমিশালি মহল্লায়। কাশ্মীর থেকে কলকাতায় আসতে এখন আর সমস্যা হচ্ছে না বলেও জানালেন তিনি। এনআরসি প্রসঙ্গ তুলতে ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘ইয়ে বিলকুল সহি নহি হো রহা।’
মেলায় রয়েছে কাশ্মীরি হস্তশিল্পের একটি বড় স্টল। সামলাচ্ছেন তিন কাশ্মীরি তরুণী। তাঁদেরই একজন ফিরদৌস। বললেন, ‘কাশ্মীরে এখনও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি।
সবসময় ফোনের লাইন পাওয়া যায় না৷ ইন্টারনেট বন্ধ৷ সব কাশ্মীরি চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন৷’ শ্রীনগরের জান মহম্মদের শালের দোকানের তরুণ কর্মী সাজাদ বললেন, ‘এ বছরই আমি প্রথম কলকাতা এসেছি। কাশ্মীরে চাকরির বড় অভাব! তাই কলকাতাই ভরসা।’
এ বছর বিধাননগর পুরনিগম আয়োজিত মেলায় স্টল হয়েছে মোট ৫৩৭টি। শুধু বাংলাদেশের স্টল ৪২টি। এছাড়াও বিদেশি স্টল রয়েছে ১৬টি।
বিনোদন পার্কও তৈরি করা হয়েছে। হচ্ছে একাধিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মেলা চলবে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রবেশ অবাধ। ওডিশা, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহারের সরকারি স্টলের পাশাপাশি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রেশমকুঠি ও মঞ্জুষার স্টল। রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর স্টল রয়েছে ৩০টি।
জমিয়ে শীত, তাই মেলায় ভালই বিক্রি হচ্ছে কাশ্মীরি জাফরান চা বা ‘কাহওয়া’। ঘোরাঘুরি বা কেনাকাটার ফাঁকে অনেকেই গলা ভেজাচ্ছেন তাতে। দাম এক কাপ ৩০ টাকা। বিক্রেতা মনজুর বিলাল কারুকাজ করা মস্ত রুপোর ‘সামোভার’ থেকে যেন নিছক চা নয়, কলকাতায় কাশ্মীরের স্বাদ ফেরি করে বেড়াচ্ছেন।