তুষারযুগের লোমশ ম্যামথরা কি এবছরেই ফিরছে পৃথিবীতে! অবিশ্বাস্য কীর্তির পথে এক বিজ্ঞানী
২০১৭ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী জর্জ চার্চ চমকে দিয়েছিলেন পৃথিবীকে। তিনি নাকি দুই বছরের মধ্যে পরিবর্তিত জিনযুক্ত হাতির ভ্রূণ তৈরি করতে সফল হবেন। জন্ম নেওয়া প্রাণীটি দেখতে একেবারে লোমযুক্ত হাতি বা ম্যামথের মতো হবে। তুষারযুগের সবচেয়ে বিখ্যাত দৈত্য ম্যামথকে আবার ফেরাবেন পৃথিবীতে।
আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকায় ও উত্তর রাশিয়া দাপিয়ে বেড়াত হাতির পূর্বপুরুষ,দামাল দাঁতাল ম্যামথরা। আলাস্কা ও সাইবেরিয়ার তুষারাচ্ছাদিত এলাকার স্থায়ী বরফের গভীরে এই তৃণভোজী দৈত্যদের কঙ্কাল, দাঁত ও দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। ম্যামথদের জীবনযাত্রা পাওয়া গিয়েছে আদিম মানুষদের আঁকা গুহাচিত্রেও।
আদিম মানুষরা ম্যামথদের হাড় বাসস্থান ও অস্ত্র তৈরির কাজে এবং দাঁত অলঙ্কার তৈরির কাজে ব্যবহার করত। লম্বায় এক একটি দাঁত কুড়ি ফুট পর্যন্ত এবং ওজনে ২০০ থেকে ২৫০ কেজি হতো। মাংসের জন্যও তারা ম্যামথ শিকার করত। পুরুষ ম্যামথ থেকে প্রায় ৬০০০ কেজি ও স্ত্রী ম্যামথ থেকে প্রায় ৪০০০ কেজি পর্যন্ত মাংস মিলত। আকৃতিতে ম্যামথ আজকের আফ্রিকান হাতির সমান ছিল। কিন্তু আজকের হাতির মতো পোষ মানেনি ম্যামথেরা।
উত্তর গোলার্ধের ম্যামথ প্রজাতিগুলির গায়ে লম্বা রোম ছিল। তুষার যুগের হিমশীতল পরিবেশে ম্যামথরা সহজেই মানিয়ে নিয়েছিল গায়ে লোম ও চর্বির আধিক্য থাকায়। ২৬ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে এসে, পৃথিবীর মূল ভূখণ্ডগুলি থেকে ম্যামথরা হারিয়ে গিয়েছিল আজ থেকে ১১,৭০০ বছর আগে। অবলুপ্ত হওয়ার পিছনে ছিল আবহাওয়ার পরিবর্তন, খাদ্যাভাব এবং দাঁত, হাড়, চামড়া ও মাংসের প্রতি মানুষের লোভ।
সেই ম্যামথকে ফেরাবে বিজ্ঞান!
তেমনই দাবি করে আসছেন জীববিজ্ঞানী জর্জ চার্চ। কিন্তু পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়া কোনও প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব? বিজ্ঞানী চার্চ বলেছেন সম্ভব। ২০০৩ সালে স্পেন ও ফ্রান্সের গবেষকরা সর্বপ্রথম bucardo বা Pyrenean ibex( Capra pyrenaica pyrenaica ) নামে এক লুপ্ত বুনো ছাগলের ক্লোন তৈরি করেছিলেন। যে প্রজাতিটি ২০০০ সালে লুপ্ত বলে ঘোষিত হয়েছিল। যদিও বিজ্ঞানীদের বানানো ছাগলটি বেশিদিন বাঁচেনি।
জীববিজ্ঞানী জর্জ চার্চ বলেছিলেন তিনি ম্যামথ বানাবেন না, একেবারে ম্যামথের মতো দেখতে রোমশ হাতি বানাবেন। কিন্তু ক্লোনিং করে ম্যামথ বানাতে গেলে লাগবে ম্যামথের কোষের নিউক্লিয়াস যার মধ্যে জিনগুলি অক্ষত অবস্থায় আছে। সেই নিউক্লিয়াসটি আবার ম্যামথের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রাণী বা হাতির ডিম্বাণুতে বসাতে হবে। তারপর কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ভ্রূণকে মহিলা হাতির জরায়ুতে বসাতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পরে জন্মগ্রহণ করবে ম্যামথ শাবক। কিন্তু বিষয়টি কি এতই সোজা!
এর আগে ২০১১ সালে জাপানের কিনকি ইউনিভার্সিটির বায়োটেকনোলজিস্ট আকিরা ইরিটানি ঘোষণা করেছিলেন, সাইবেরিয়ার স্থায়ী বরফের তলায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া ম্যামথের কোষগুলি থেকে ক্লোন করার মতো উপযুক্ত উপাদান বা নিউক্লিয়াস মিলেছে। ইরিটানি বলেছিলেন পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি আবার পৃথিবীর মাটিতে ম্যামথকে হাঁটাবেন। মিডিয়াতে প্রচুর প্রচার পেয়ে গিয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী। ২০১৬ সাল কেটে গেলেও ইরিটানি তাঁর কথা রাখেননি। সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ক্লোন করা ম্যামথ পৃথিবীর আলো দেখেনি।
তাহলে কীসের জোরে দাবি করছেন বিজ্ঞানী চার্চ!
২০১৫ সালে Swedish Museum of Natural History জীবাশ্মবিজ্ঞানী লাভ দালেনের নেতৃত্বে এক দল বিজ্ঞানী ম্যামথের দেহে যেরকম জিন ছিল সেইরকম জিনের ম্যাপ বানিয়ে ফেলেন। দরজা খুলে যায় বিজ্ঞানী চার্চের কাছে। সুযোগসন্ধানী চার্চ বিজ্ঞানী দালেনের সাফল্যকে কাজে লাগান নিজের গবেষণায়। ২০১৫ সালেই চার্চ ঘোষণা করেন, তিনি একটি এশিয়ার হাতির চামড়ার কোষকে স্টেম সেলে পরিণত করবেন, যে স্টেমসেল ভ্রূণ তৈরি করতে সক্ষম। বিজ্ঞানী চার্চ তাঁর পরীক্ষায় এশিয়ার হাতি নিলেন, কারণ এরা হচ্ছে হচ্ছে ম্যামথের নিকট আত্মীয়।
চার্চ বলেছিলেন, তিনি কিন্তু নিখুঁত ম্যামথ তৈরি করছেন না, তাঁর তৈরি হাতি দেখতে ম্যামথের মতো হবে। এই হাইব্রিড হাতি তার জন্মের আগেই ম্যামোফ্যান্ট (ম্যামথ+এলিফ্যান্ট) নাম পেয়ে গেল। নকল ম্যামথ বা ম্যামোফ্যান্ট বানাতে কী করবেন চার্চ সেটাও জানিয়েছিলেন। তিনি এশিয়ার হাতির জিনে এমন কিছু কারিগরি করবেন যাতে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হওয়া ম্যামোফ্যান্ট আকৃতিতে ম্যামথের মতো হবে। ম্যামথের মতোই প্রচণ্ড ঠান্ডায় বাঁচতে পারবে। তাদের দাঁত ও লোম ম্যামথের মতো বড় বড় হবে। গায়ে চর্বির পরিমাণও হবে ম্যামথের মতোই।
এর জন্য বিজ্ঞানী চার্চ CRISPR নামে জেনেটিক এডিটিং টুল ব্যবহার করেছিলেন। ২০১৭ সালে চার্চ ঘোষণা করেছিলেন, তিনি এশিয়ার হাতির ৪৫ টি জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ম্যামথের জিনের মতো করে দিয়েছেন। তাঁর আর মাত্র দু’বছর লাগবে ম্যামথ তৈরি করতে, ২০১৯ সালে পৃথিবীর বুকে ভুমিষ্ঠ হতে চলেছে ম্যামোফ্যান্ট।
হেসেছিলেন জীবাশ্মবিজ্ঞানী লাভ ডালেন
তিনি OpenMind পত্রিকায় জানিয়েছিলেন তাঁরা ম্যামথের জিনের ম্যাপ বানালেও তা ছিল অসম্পূর্ণ। তাঁরা যে নমুনার ওপর ভিত্তি করে থেকে ম্যাপটি বানিয়েছিলেন, তা সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত হলেও বহু জিনের সন্ধান তাঁরা পাননি। ম্যামথের ডিএনএ-র কিছু নির্দিষ্ট টুকরো আজও তাঁরা আবিষ্কার করতে পারেননি। সেটুকু অংশ হাতির ডিএনএ-র অনুকরণে ভরাট করা হয়েছে। ম্যামথ বা ম্যামথের মতো প্রাণীকে ফেরাতে সেই জিনগুলি লাগবেই। এছাড়া বিজ্ঞানী চার্চ মাত্র ৪৫টি জিনের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, কিন্তু হাজার হাজার জিনের পরিবর্তন এখনও বাকি।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, নতুনভাবে সৃষ্টি করা ম্যামথকে পরিবেশে ফেরানো কি আদৌ যুক্তিযুক্ত, পৃথিবীর বুকে কঠিন জীবনসংগ্রামে এই নতুন প্রাণীটি টিকতে পারবে তো! ম্যামথদের বাসযোগ্য আবহাওয়া, পরিবেশ এবং খাদ্য যে পৃথিবীতে আজ আর নেই!
বিজ্ঞানী চার্চ সেদিকেও ভেবে রেখেছেন
যোগাযোগ রেখে চলছেন রাশিয়ার বিজ্ঞানী সার্গেই ও নিকিতা জিমোভের সঙ্গে। এই পিতা-পুত্র জুটি ১৯৯৬ সাল থেকে সাইবেরিয়ায় প্লিসটোসিন পার্ক রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। ১৪৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা এই সংরক্ষিত এলাকায় তাঁরা বড় বড় তৃণভোজী প্রাণী ছেড়েছেন, তুষার যুগের পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে। যে প্রাণীগুলি এই অঞ্চলে বাসই করত না। কিন্তু দেখা গেছে তারা সাইবেরিয়ার তুষারজমা পার্কের চুড়ান্ত হিমশীতল পরিবেশে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে। সার্গেই জিমোভের মতে জর্জ চার্চের তৈরি করা ম্যামথ বা ম্যামোফ্যান্ট তাঁদের পার্কে দিব্যি মানিয়ে নেবে।
কিন্তু জর্জ চার্চের দেওয়া সময়সীমাও পেরিয়ে গেছে। ২০১৯ পেরিয়ে এসে গেছে ২০২০ সাল। পৃথিবীতে আসেনি ম্যামথ বা ম্যামোফ্যান্ট। এখনও চুপ বিজ্ঞানী জর্জ চার্চ। কেন তিনি চুপ! আবার তিনি চমক দিতে চান, তাই অপেক্ষা করাচ্ছেন পৃথিবীকে! কিছুদিনের মধ্যেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন রাশিয়ার বিজ্ঞানী সার্গেই ও নিকিতা জিমোভ এবং স্বয়ং জর্জ চার্চ।
রূপাঞ্জন গোস্বামী