দেশব্যাপীব্যবসা বাণিজ্যজীবনশৈলীসব খবর

তিনটি দিবসকে সামনে রেখে গদখালির চাষিদের ব্যস্ততা: মাত্র দুই সেন্টিমিটার উচ্চতা কম হওয়ায় ইউরোপের বাজারে রফতানি করা যাচ্ছেনা গোলাপ

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে উৎপাদিত গোলাপ ফুল মাত্র দুই সেন্টিমিটার উচ্চতা কমের কারণে ইউরোপের বাজারে রফতানি করা যাচ্ছেনা। ইতিমধ্যে একটি চালান ইউরোপ থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এতে টনক নড়েছে ফুল চাষিদের। তারা ইউরোপের বাজারে ফুল রফতানির আশায় এবার পলি হাউজে ফুলের আবাদ করছেন। চাষিরা বলছেন, পলি হাউজে তাপমাত্রা সঠিক মাত্রায় থাকার কারণে ইউরোপ দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী গোলাপ ফুল উৎপাদন হবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ফেরুয়ারি মাসে তিনটি দিবসে ফুলের বাজার ধরতে চাষিরা ব্যস্ত রয়েছেন ক্ষেতে ফুল আবাদ নিয়ে। চাষিরা গোলাপের কুঁড়িতে পরিয়ে দিয়েছেন সাদা ক্যাপ। ফুল যেন ফোটে দেরি করে। আগামী ১৩, ১৪ ও ২১ ফেরুয়ারির বাজার ধরতেই তাদের এই আপ্রাণ চেষ্টা। আবহাওয়া অনুকুল থাকলে এবার তারা ২০ কোটি টাকার বেশি ফুলের বিকিকিনি করতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করছেন। গত বছরও তাদের ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল।

ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের মোকলেসুর রহমান এবার দুই একর জমিতে গোলাপ ফুলের আবাদ করেছেন। ফুলের ফলন ভালো হয়েছে। ফুলক্ষেতে তিনি ক্যাপ ব্যবহার করছেন। সামনের তিনটি দিবসের বাজার ধরতে তারা ব্যস্ত। ২-৩ দিন আগে ক্ষেতের ক্যাপ খুলে ফেলবেন। এসময় ফুল বাজার উপযোগী হবে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় সরকারিও বেসরকারি অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার হওয়ায় তারা ব্যবসায় মার খাচ্ছেনা বলে জানান তিনি। একই সাথে তিনি বলেন, আমাদের অঞ্চলের ফুল চাষিরা ইউরোপের বাজার ধরতে নতুন পদ্ধতি পলিহাউজে গোলাপ ফুলের আবাদ করছেন। আমিও দুই বিঘা জমিতে পলি হাউজে আবাদ করছি।

নীলকন্ঠনগর গ্রামের চাষি কামারুল ইসলাম জানান, তিনি ৫০ শতক জমিতে পলিহাউজের মাধ্যমে গোলাপের আবাদ করছেন। এতে ফুলের রঙ ও উচ্চতা সঠিক মাপে হচ্ছে। পটুয়াপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি ২ বিঘা জমিতে গোলাপের আবাদ করছেন। ফেরুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এগুলো ক্ষেত থেকে তুলবেন। একই সাথে ইউরোপের বাজারে গোলাপ রফতানির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ফেব্রুয়ারি মাসে রয়েছে বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবস আর মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি পহেলা বসন্ত, পরদিন ভালোবাসা দিবস। এ দুটি দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে মুখিয়ে আছে দেশের তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সীরা।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের বহু চাষি তাদের জমিতে ধান, পাটের চাষ চুকিয়ে সারা বছরই ফুল চাষ করছেন। তাদের উৎপাদিত রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল সারাদেশের মানুষের মন রাঙাচ্ছে। বিশেষ করে বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবসে এসব ফুলের বিকল্প নেই। আর ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও রয়েছে এ ফুলের ব্যাপক চাহিদা। তাই বছরের এ তিনটি দিবসকে ঘিরেই হয় মূল বেচাকেনা।

পটুয়াপাড়ার বাসিন্দা ফুলচাষি সাহিদা বেগম বলেন, ‘আমরা গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রাখি, যাতে ফুল একটু দেরি করে ফোটে। কেননা বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবস আর ২১ ফেরুয়ারিতে যাতে ফুল বাজারে দেওয়া যায়। প্রতিটি গোলাপে ক্যাপ পরানোসহ খরচ প্রায় পাঁচ টাকার মতো। যদি ৮-১০ টাকা বিক্রি করা যায় তাহলে ভালো মুনাফা হবে।

ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, এবার আমি ১৫ বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা, ডাবল রজনীগন্ধা (ভুট্টা) ও হাইব্রিড রজনীগন্ধা (উজ্জ্বল), গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা এবং গ্লাডিওলাস চাষ করেছি। ইংরেজি নববর্ষে ব্যবসা হয়নি। কিন্তু বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস এবং মহান শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে ৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করছি।

জারবেরা ফুল ব্যবসায়ী আশরাফুল আলমের সহযোগী রনি ইসলাম বলেন, এখন প্রতি সপ্তায় ৬-৭ হাজার পিস ফুল বিক্রি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসের তিন উৎসবকে সামনে রেখে আমরা কমপক্ষে ৭ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি ও গদখালি ফুল চাষি কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা এই ফুলকে কন্দ্র করে। প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুলচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এরমধ্যে কেবল যশোরেই প্রায় ৫-৬ হাজার ফুলচাষি রয়েছেন।

সারা বছর টুকটাক ফুল বিক্রি হলেও মূলত ফেব্রুয়ারি মাসের তিনটি দিবসকে সামনে রেখেই জোরেশোরে এখানকার চাষিরা ফুল চাষ করে থাকেন। এবার ফুলের দাম বাড়ার কারণে ২০ কোটি টাকা বিক্রি ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আমরা অস্ট্রেলিয়ায় ৪ হাজার পিস গোলাপ ফুল পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা দুই সেন্টমিটার উচ্চতা কম এবং রঙ খারাপের কারণে ফেরত পাঠিয়েছিল। এখন আমরা পলি হাউজের মাধ্যমে ইউরোপের বাজার চাহিদা উপযোগী গোলাপ উৎপাদন করছি। ইউরোপের বাজারে গোলাপ ফুলের উচ্চতা প্রয়োজন ৩৮ সেন্টিমিটার, কিন্তু আমাদের উৎপাদন হচ্ছে ৩৬ সেন্টিমিটার।

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ফুলের আবাদ হয়েছিল ৬৩২ হেক্টর, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৩৩ হেক্টর এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আবাদ হয়েছিল ৬৩৬ হেক্টর জমিতে। চলতি বছরেও একই পরিমান জমিতে ফুলের আবাদ হয়েছে। ফুল উৎপাদন হয়ে থাকে গড়ে ৫৮ কোটি ৮৩ লাখ ১৭ হাজার ৮৫৫ পিস। হেক্টর প্রতি ফুল উৎপাদন হয়ে থাকে ৯ লাখ ৩৫ হাজার ২৮ পিস। আর গোলাপ ফুল উৎপাদন হয় ৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৮৬ পিস।

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক এমদাদ হোসেন জানান, জেলায় ৬৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের আবাদ করা হয়েছে। দেশে ফুলের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগই যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে এই ফুল এখন যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াতেও। কিন্তু ইউরোপের বাজারে ফুল পাঠাতে ফুলের রঙ ও উচ্চতা প্রয়োজন। সেদিকে নজর রেখে গদখালির চাষিরা পলিহাউজে ফুলের আবাদ বাড়াচ্ছে।

/ মোজাহো

বেনাপোল (যশোর) করেসপনডেন্ট

Md. Jamal Hossain Mobile: 01713-025356 Email: jamalbpl@gmail.com Blood Group: Alternative Mobile No: Benapole ETV Correspondent

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *