পিকনিক ট্রাজেডির ৬ বছর : অশ্রুতে স্মরন করলো বেনাপোলবাসি
‘বুকে তীর বিদ্ধ অবস্থায় উড়ছে ৯টি কবুতর। শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। আর পাশেই রক্তের স্রোতে বইয়ের বর্ণমালা মুছে যাচ্ছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘আমার বর্ণমালা তুমি ভালো থেকো।’ বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নির্মিত হয়েছে এসব নিহত শিশু শিক্ষার্থীদের স্মরণে একটি স্মৃতি স্তম্ভ। ১৫ ফেব্রুয়ারী বেনাপোল পিকনিক ট্রাজেডির ছয় বছর। এদিনটিকে ঘিরে শনিবার বেনাপোলে শোক দিবস পালিত হয়েছে।
২০১৪ সালের এই দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯ শিশু শিক্ষার্থী। এসময় আরো ৪৭ জন শিক্ষার্থী ও ৩/৪ শিক্ষক আহত হয়। শোকের এই দিনটিকে ঘিরে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি উদ্যোগে নেয়া হয় নানা কর্মসুচী। সকালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন, শোক র্যালি, স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, স্মরণ সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
সকালে স্কুল থেকে যশোর-১ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ¦ শেখ আফিল উদ্দিনের নেতৃত্বে এক বিশাল শোক র্যালি বের করা হয়। র্যালি শেষে নিহতদের স্মরনে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভে জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ¦ শেখ আফিল উদ্দিনসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে নিহত শিশুদের স্মরন করেন। শোক র্যালি ও দোয়া অনুষ্ঠানে বেনাপোলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীসহ সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ অংশ গ্রহন করেন। এ সময় নিহতদের স্বজনেরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এদিন যেন পুরো বেনাপোল শোকের নগরীতে পরিনত হয়।
স্মৃতি স্তম্ভে পুস্প অর্পন শেষে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোস্তাক হোসেন স্বপনের সভাপতিত্বে আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য আলহাজ শেখ আফিল উদ্দিন।
অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শার্শা উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব সিরাজুল হক মঞ্জু, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আলহাজ্ব নুরুজ্জামান, যশোর জেলা পরিষদের সদস্য অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল, উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুর রব, বেনাপোল পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব এনামুল হক মুকুল, সাধারন সম্পাদক নাসির উদ্দীন, বেনাপোল ইউপি চেয়ারম্যান বজলুর রহমান, শার্শা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি অহিদুজ্জামান অহিদ, স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি জুলফিকার আলী মন্টু, ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রহিম সরদার, সাধারন সম্পাদক ইকবাল হোসেন রাসেলসহ বেনাপোলের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা উপস্থিত ছিলেন।
স্মরণ সভায় শেখ আফিল উদ্দিন এমপি বলেন, শার্শাবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম তার সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে সুসন্তানে পরিণত করতে হবে। আশায় বুক বেঁধেছিলেন সকল মায়েরা-বাবারা। সন্তানকে বলেছিলো তোকে ডাক্তার বানাবো, ইঞ্জিনিয়ার বানাবো, দেশের বড়ো অফিসার বানাবো। কিন্তু অমানিশার এক অন্ধকারে যখন নয়-নয়টি শিশু লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরল তখন কে দেবে তার মাকে সান্তনা? দু’নয়নে কেবল জল। বাবা হতবাক! বুকফাটা আর্তনাদে আঁছড়ে পড়ছে মা। ঘটনার ৬ বছর অতিবাহিত হলেও এযেন সদ্য শিশু সন্তান হারানোর বেদনায় আবারো শোকের মাতম বয়ে যায় বেনাপোল জুড়ে।
তিনি আরো বলেন, ক্ষমা করে দিও মা! আমরা পারিনি তোমার আদরের সোনামণি সুরাইয়া, জেবা, মিথিলা, মীম, শান্ত, ইয়ানুর, ইকরামুল, সাব্বির ও আঁখিকে বাঁচাতে। এখন থেকে শার্শা উপজেলার কোন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দূর-দূরান্তে শিক্ষা সফরে আর যাবে না।
২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারী বেনাপোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সফরে মেহেরপুরের মুজিবনগরে যায়। সেখান থেকে ফেরার পথে চৌগাছার ঝাউতলা কাঁদবিলা পুকুর পাড়ে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৭ জন শিক্ষার্থী, আহত হয় আরো ৭০ জন শিশু শিক্ষার্থী ও ৩/৪ জন শিক্ষক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ২ জন শিক্ষার্থী মারা যান। ঘটনাস্থলে নিহতরা হলো, বেনাপোল পৌরসভার ছোটআঁচড়া গ্রামের সৈয়দ আলীর দুই মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুরাইয়া (১০) ও তার বোন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী জেবা আক্তার (৮), ছোটআঁচড়া গ্রামের ইউনুস আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী মিথিলা (১০), রফিকুল ইসলামের মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী রুনা আক্তার মীম (৯), লোকমান হোসেনের ছেলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শান্ত (৯), গাজিপুর গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সাব্বির হোসেন (১০) ও নামাজ গ্রামের হাসান আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আঁখি (১১)। ১৩ দিন পর ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ছোটআঁচড়া গ্রামের মনির হোসেনের ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ইকরামুল (১১) সর্বশেষ দুর্ঘটনার ৩২ দিন পর ১৯ মার্চ ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় একই গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইয়ানুর রহমান (১১)।
দিন মাস পার হয়ে ফিরে এসেছে ছয় বছর পর ঠিক এই দিনটি। কিন্তু ফিরে আসিনি হারিয়ে যাওয়া ৯ শিশু শিক্ষার্থী। আজো কাঁন্না থামেনি হারিয়ে যাওয়া এ সব শিশুদের পরিবারের। পথ চেয়ে বসে আছে এই বুঝি ফিরে আসছে তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানেরা। ঝঁরে যাওয়া ফুল ফিরে পাবেনা পরিবারের সদস্যরা। তাদেরকে অশ্রæতে স্মরন করলো ছয় বছর পর আবারও বেনাপোলবাসি।
/ মোজাহো