বাড়ল বিদ্যুতের দাম খরচ বাড়বে সব খাতে
বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার ঘোষণা করে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৪০ পয়সা এবং খুচরা ৩৬ পয়সা বাড়ানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ১ মার্চ থেকে এ মূল্যহার কার্যকর হবে। অর্থাৎ প্রিপেইড গ্রাহকরা ওই দিন থেকেই এবং পোস্টপেইড গ্রাহকরা এপ্রিল থেকে বর্ধিম দামে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করবেন।
অর্থনীতিবিদ এবং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দামবৃদ্ধির ফলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ চাপে পড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বড়ো চ্যালেঞ্জে পড়বে শিল্প-কারখানা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ না দিয়ে দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয়। বর্ধিত বিদ্যুৎ বিলের ভার বহনের সক্ষমতা শিল্পের নেই। ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের সংগঠকরা জানান, সিস্টেম লস, ভুল নীতি-পরিকল্পনা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে জোর না দিয়ে দামবৃদ্ধির প্রতি মনোযোগ সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার। এক শ্রেণির কর্মকর্তা-ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিতে জনগণের উপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তবে বিইআরসি বলছে, দেশের বাজার পরিস্থিতি এবং গ্রাহকদের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের উপর যেন চাপ না পরে সেদিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে শিল্পের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ব্যয় যাতে খুব বেশি না বৃদ্ধি পায় সে দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।
আবাসিকে কত বৃদ্ধি
গৃহস্থালির খুচরা বিদ্যুতের মূল্যহার লাইফ লাইনে (০-৫০ ইউনিট) তিন টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে তিন টাকা ৫৭ পয়সা করা হয়েছে। সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে (০-৭৫ ইউনিট) ৪ টাকা থেকে বেড়ে ৪ টাকা ১৯ পয়সা, দ্বিতীয় ধাপে (৭৬-২০০ ইউনিট) ৫ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে ৫ টাকা ৭২ পয়সা, তৃতীয় ধাপে (২০১-৩০০ ইউনিট) ৫ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ছয় টাকা, চতুর্থ ধাপে (৩০১-৪০০ ইউনিট) ৬ টাকা ০২ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৩৪ পয়সা, ৫ম ধাপে (৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট) ৯ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা এবং ৬ষ্ঠ ধাপে ৬০০ ইউনিটের উর্ধ্বে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা করা হয়েছে।
কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে যত বাড়লো
গৃহস্থালির পাশাপাশি দাম বেড়েছে কৃষি সেচ, শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও। নতুন দাম অনুযায়ী কৃষিতে ইউনিট প্রতি ১৬ পয়সা দাম বেড়েছে। আগে কৃষি সেচে এক ইউনিট বিদ্যুতের দাম ছিল ৪ টাকা। এখন তা হয়েছে চার টাকা ১৯ পয়সা। এর আগে সেচে দাম বাড়ানো না হলেও ২০১৭ সালে সর্বশেষ দাম বৃদ্ধির সময় তিন টাকা ৮২ পয়সা থেকে দাম বাড়িয়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
ক্ষুদ্র শিল্পর জন্য নতুন দাম হচ্ছে ফ্ল্যাট ৮ টাকা ৫৩ পয়সা, অফপিকে ৭ টাকা ৬৮ পয়সা এবং পিক আওয়ারেও ১০ টাকা ২৪ পয়সা। নির্মাণে নতুন দাম ইউনিট প্রতি ১২ টাকা ধর্মীয়, শিক্ষা এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দাম হচ্ছে ৬টাকা ২ পয়সা, রাস্তার বাতিতে ৭টাকা ৭০ পয়সা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ফ্ল্যাট রেট ইউনিট প্রতি ১০ টাকা ৩০ পয়সা, অফপিকে ৯ টাকা ২৭ পয়সা এবং পিকে ১২ টাকা ৩৬ পয়সা।
এছাড়া ইলেকট্রিক যানের ব্যাটারি চার্জ দিতে পৃথক বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ফ্ল্যাট ৭ টাকা ৬৪ পয়সা, অফ পিক ৬ টাকা ৮৮ পয়সা, সুপার অফ পিক ৬ টাকা ১১ পয়সা এবং পিক ৯ টাকা ৫৫ পয়সা দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কাওরান বাজারে টিসিবি ভবনে মূল্যবৃদ্ধির সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, দাম বাড়ানোর জন্য কমিশন যেসকল বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে তার মধ্যে আমদানিকৃত কয়লার উপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি, অবচয় ব্যয় বৃদ্ধি, তুলনামূলক কম মূল্যে পল্লী বিদ্যুত্ সমিতিগুলোর অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনা এবং এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির অর্থায়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল সেগুলোর সুদ পরিশোধ এবং প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দামের উপর ১০ পয়সা হারে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা। এইসব বিষয় বিবেচনা করে দাম বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, এই দাম মার্চ মাস থেকে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে।
কত বেশি খরচ হবে জনগণের
বর্ধিত মূল্যহার বিশ্লেষনে দেখা যায়, পাইকারি পর্যায়ে পিডিবিকে বছরে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিবে সরকার। আগামী এক বছরে ৭ হাজার ১৩৫ কোটি কিলোওয়াট বিদ্যুত্ বিক্রি করবে বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলো। বিক্রি থেকে তাদের রাজস্ব আয় হবে ৫০ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এতে তাদের মুনাফা হবে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রাক্কলন অনুযায়ী বিদ্যুৎ খরচ হলে বছরে এই ২ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হবে জনগণের পকেট থেকে।
উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা
চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত-সংঘর্ষ আঞ্চলিক ব্যবসার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি দেশের শিল্পের শক্তি অনেকখানি কমিয়ে দিবে। আর ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাও কঠিন হবে। সেচ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কৃষিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সব মিলিয়ে এ বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি অনেকটা ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে এসেছে।
বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিটিএমএ’র পক্ষ থেকে বলা হয়, বস্ত্রখাত গত প্রায় দুই বছর যাবত সুতা ও কাপড়ের অবৈধ অনুপ্রবেশ ও তা বিপণনের কারনে স্থানীয় টেক্সটাইল খাত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুতের অপর্যাপ্ত সরবরাহ ও মানসম্পন্ন বিদ্যুতের অভাবসহ অন্যান্য কারনে অনেক ছোট ও মাঝারি মানের ফেব্রিক মিল তাদের উত্পাদন ক্ষমতার উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যবহার না করতে পেরে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। এ পর্যন্ত তিন শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধিতে উদ্বেগ বেড়ে গেছে।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক ইত্তেফাককে বলেন, গত চার বছরে শিল্পের উত্পাদন ব্যয় বেড়েছে ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে পোশাকের দাম না বেড়ে বরং কমছে। এ পরিস্থিতিতে বর্ধিত বিদ্যুতের চাপে টিকে থাকা আরো কঠিন হবে। এই সিদ্ধান্ত শিল্পের জন্য ভালো হলো না।
বিকেএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বর্ধিত বিদ্যুত্ বিলের এই ভার বহন করার ক্ষমতা শিল্পের নেই। বিদ্যুতের বিল বাড়ানো তো উচিতই হয়নি। বরং আগামী দুই বছরের জন্য কমানো দরকার ছিলো।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ ইত্তেফাককে বলেন, করোনা ভাইরাসের কারনে বানিজ্যিক কার্যক্রম নিম্নমুখী। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দর বৃদ্ধি শিল্পসহ ব্যবসায়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর এর প্রতিক্রিয়া হবে বেশি।