দেশব্যাপীব্যবসা বাণিজ্যজীবনশৈলীশিরোনামসর্বশেষসব খবর

করোনাভাইরাসে শত কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা গদখালীর ফুল চাষিদের: গরু-ছাগল দিয়ে ফুল খাইয়ে দিচ্ছেন

দেশের ফুলের রাজ্য খ্যাত যশোরের গদখালী। এখানেই ফুল বেচাকেনার জন্য গড়ে উঠেছে বড় পাইকারি বাজার। প্রতিদিন পূর্ব আকাশে লাল সূর্য উঁকি দেওয়ার সাথে সাথে জমে উঠতো ফুলের বাজার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় পাইকাররা ফুল কিনে নিয়ে খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ফুলের রং ছড়িয়ে দিতেন বিভিন্ন বয়সী মানুষের মনে। কিন্তু এখন ভিন্ন চিত্র। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে ঘটেছে ছন্দপতন। করোনার প্রাদুর্ভাবে গদখালীর ফুলের বাজার মানবশূন্য। গদখালীতে এখন করুণদশা। ফুল বিক্রি করতে না পেরে কেটে কেটে ফেলে দিচ্ছেন কৃষক। কোথাও কোথাও গরু ছাগলকে দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। কেউ কেউ অবিশ্বাস্য কম দামে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করছেন ফুল। কিন্তু ক্রেতাও নেই।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের মাঠে মাঠে এখন প্রস্ফুটিত গোলাপ, জারবেরা, গøাডিওলাস, রজনীগন্ধা ও গাঁদা ফুল। এমন পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুল সাধারণত চোখে পড়েনা। গোলাপ বা জারবেরা তার পাপড়ি পুরোপুরি মেলে ধরার আগেই তা কেটে বাজার নেন ফুল চাষিরা। কিন্তু এখন চিত্র ভিন্ন। ফুল বিক্রি করতে পারছেন না চাষিরা, তা ক্ষেতেই থেকে যাচ্ছে।

গদখালী ফ্লাওয়ার সোসাইটি সূত্র মতে, ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারার প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কৃষক ৬ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করছেন। ফুল চাষে আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার রেকর্ড পরিমাণ ফুলের উৎপাদন হয়েছিলো। ছাড়িয়ে ছিল দামও। দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম গদখালী ফুল বাজারে প্রায় ১২ রকমের ফুল বেচাকেনা হয়। প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফুলের ভরা মৌসুম। কিন্তু করোনাভাইরাসে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা বর্ষবরণ উৎসব ঘিরে ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীদের অন্তত ১শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি গদখালী ফ্লাওয়ার সোসাইটির।

গদখালীর পটুয়াপাড়ার মঞ্জুর আলম বলেন, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে জারবেরা ও চার বিঘা জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করেছেন। কিন্তু গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ফুল বেচতে পারেনি, আবার আসন্ন পহেলা বৈশাখেও একই অবস্থা হবে। তিনি আরও জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে সকল অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ফুল জেলার বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না চাহিদা না থাকায়। এ অবস্থায় গাছ বাঁচিয়ে রাখতে তাদেরকে ফুল তুলতে হচ্ছেই। কিন্তু ক্রেতা না থাকায় কাটা ফুলগুলো তারা গবাদী পশুকে দিয়ে খাওয়াচ্ছেন।

একই ধরনের কথা বলেন পটুয়াপাড়ার মেহেদি হাসান ও সৈয়দপাড়ার সেলিম মাল। গদখালী বাজারে অবস্থিত ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও ফুল প্যাকেজিং ও বাজারজাতকরণ কেন্দ্র একেবারেই জনশূন্য। কয়েকদিন আগেও যেখানে ভোর সকাল থেকে ফুলের বেচাকেনা চলে সেখানে রোববার বিকেলে মাত্র তিনজনকে দেখা যায়।

তাদের মধ্যে একজন উজ্জল হোসেন জানালেন, গদখালী ফুলের মোকামে কোন খরিদ্দার নেই। করোনাভাইরাস আতঙ্কে পাইকাররা আসছেন না। এসময় তারা খুব কম দামে ফুল কিনে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, আগে যেখানে প্রতিটি গোলাপ ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন তারা প্রতি ১শ’ গোলাপ ফুল বিক্রি করছেন মাত্র ২০ টাকায়। পঞ্চাশ পিসের এক আটি জারবেরা, গøাডিউলাস ও রজনীগন্ধা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায় এবং এক হাজার গাঁদা ফুল বিক্রি করছেন ৫০ টাকায়।

গদখালীর সৈয়দপাড়া গ্রামের সেলিম বলেন, ফুল তুলে তারা গরু দিয়ে খাওয়াচ্ছেন অথবা ফেলে দিচ্ছেন। কিন্তু ফুল তুলতে মজুরি খরচ লাগে। খুব কম দামে ফুল বিক্রি করে তারা সেই খরচটা তোলার চেষ্টা করছেন।

গদখালী এলাকার কৃষক শাহজাহান জানান, তার আড়াই বিঘা গোলাপ ফুলের ক্ষেত এখন ছাগলের খাদ্যতে পরিণত হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে ১২ দিন ধরে ফুলের বেচাকেনা নেই। এদিকে বাগান থেকে প্রতিদিনই দেড় থেকে দুই হাজার গোলাপ তুলে ছাগল-গরু দিয়ে খাওয়াতে হচ্ছে। কারণ গোলাপ না তুললে বাগান নষ্ট হয়ে যায়। একদিকে ফুলের বেচাকেনা নেই। অন্যদিকে ফুল তোলার জন্যে শ্রমিক খরচ হচ্ছে। প্রতিদিনই শাহজাহানের দুই হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।

পানিসারা এলাকার ফুল চাষি শের আলী জানান, আড়াই বিঘা জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করেছি। বাংলা বর্ষবরণ উৎসব সামনে রেখে ফুল উৎপাদনের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। কয়েক লাখ টাকা গোলাপ বাগানে বিনিয়োগ করা আছে। ঠিক সেই সময়ে করোনাভাইরাসের দুর্যোগের কারণে ১২ দিন ধরে পরিবহন-দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ফুলের বাজার বসছে না। ক্ষেত থেকে প্রতিদিনই দেড় হাজারের বেশি গোলাপ তুলে ছাগল গরু দিয়ে খাওয়াতে হচ্ছে। ফুল না তুললে নতুন করে আর কুঁড়ি আসে না। অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় আছি আমরা। তিনি আরো বলেন, শুধু আমি না এই এলাকার সকল ফুলচাষি এমন বিপাকে পড়েছেন। তাদের বাগানের রজনীগন্ধা, গøাডিওলাস, জারবেরা ফুল কেটে গরু দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নেয়া সতর্কতায় সৃষ্ট অবস্থার কারণে যশোরে ৬ হাজার ফুলের কৃষক ও ফুলের উপর নির্ভরশীল দেড় লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সারা দেশে এ অবস্থার শিকার ২০ হাজার কৃষক ও ২০ থেকে ২৫ হাজার পাইকারি বিক্রেতা। গদখালীর পাইকারি ফুলের বাজার ২৪ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। চাষিরা ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। আবার ক্ষেতে ফুল রাখতেও পারছেন না। এরকম উভয় সংকটে পড়েছেন তারা।

জাতীয় দিবসগুলোই ফুল বিক্রির অন্যতম সময়। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস ও ১৪ এপ্রিল বাংলা বর্ষবরণ উৎসব ঘিরে যশোর অঞ্চলে ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীদের অন্তত ১ শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফুল খাতে সারা দেশে আড়াই শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হবে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখনই কৃষকদের খাদ্য সরবরাহ ও বিনা সুদে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দাবিতে আমরা কৃষিমন্ত্রী ও সচিব বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছি। যশোরের জেলা প্রশাসক ও ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে।

/ মোজাহো

বেনাপোল (যশোর) করেসপনডেন্ট

Md. Jamal Hossain Mobile: 01713-025356 Email: jamalbpl@gmail.com Blood Group: Alternative Mobile No: Benapole ETV Correspondent

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *