১১ জন বিদ্রোহী সেনাকে ইংরেজরা ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ঢাকার ‘বাহাদুর শাহ’ পার্কে
পুরোনো ঢাকা বেশ গমগমে জায়গা। এখানে যেমন চকবাজার রয়েছে, তেমনি আছে নয়াবাজার, মিডফোর্ড, সিদ্দিকবাজার, নবাবপুরের মতো বেশ কিছু অর্থনৈতিক ঘাঁটি। ঢাকার অন্যতম প্রধান নৌবন্দর সদরঘাটের অবস্থানও পুরোনো ঢাকাতেই। সদরঘাট এলাকাতে ঢুকতেই লক্ষ্মীবাজারের ঠিক মাথায় লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা এক পার্কের দেখা মিলবে। ৭টি রাস্তা একত্রিত হয়েছে পার্কটিকে কেন্দ্র করে।

এই পার্কটি বেশ পুরোনো। ১৮ শতকের শেষ ভাগে এখানে ঢাকানিবাসী আর্মেনিয়ানদের বিলিয়ার্ড খেলার ক্লাব ছিল। আশেপাশের মানুষরা কথ্য ভাষায় বিলিয়ার্ডকে ‘আন্টা’ নামে ডাকত। আর ক্লাবটাকে বলত ‘আন্টাঘর’। ক্লাব সংলগ্ন মাঠটি পরিচিত ছিল ‘আন্টাঘর ময়দান’ নামে।
১৯ শতকের শুরুতে ব্রিটিশরা জায়গাটিকে কিনে নেয়। তারাই এখানে পার্ক তৈরি করে। পার্কের চারদিক লোহা দিয়ে ঘিরে দেয়, চার কোণে বসায় চারটে কামান। ঢাকার নবাব স্যার আব্দুল গনি তখন পার্কের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা এখানে বিলিয়ার্ড, টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলত, পার্টি করত, আড্ডা দিত।
১৮৫৭ সালে সারা দেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে শুরু হয় বিদ্রোহ। সেই মহাবিদ্রোহের আঁচ এসে পড়েছিল ঢাকাতেও। লালবাগ কেল্লার দেশীয় সেনারাও বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন। ২২ নভেম্বর এঁদের আক্রমণ করে ব্রিটিশ মেরিন সেনারা।
ঢাকার নবাব আব্দুল গনি ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিলেন। দেশীয় সেনারাও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। জোরদার যুদ্ধে অনেক বিদ্রোহী মারা যান, অনেকে পালিয়ে যান ময়মনসিংহের দিকে। পালিয়ে যাওয়া সেপাইদের মধ্যে বেশ করেকজনকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ সেনা।
যুদ্ধে আহত এবং পালিয়ে যাওয়া বিদ্রোহী সেনাদের হল কোর্ট মার্শাল। শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আন্টাঘর ময়দানে জনগণের সামনে প্রকাশ্যে ১ জন মহিলা-সহ ১১ জনকে ফাঁসিতে চড়ানো হল। সাধারণ মানুষ যাতে বিদ্রোহ করতে সাহস না পায়, তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে বিদ্রোহী সেনাদের লাশগুলোকে দিনের পর দিন ময়দানের গাছে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
জায়গাটা নিয়ে ভূতুড়ে গল্প রটে গেল চারপাশের অঞ্চলে। অন্যদিকে, বিদ্রোহ দমনের পর ইংরেজরা তাদের বাহিনীর মৃত সেনাদের স্মরণে এক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে এই ময়দানে।
মহাবিদ্রোহের পর ভারতের শাসনক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে নিজের হাতে তুলে নেয় রানি ভিক্টোরিয়ার সরকার। তখন এই পার্কের নাম হয়ে যায় ভিক্টোরিয়া পার্ক। ক্লাবটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাবেরা। ১৮৮৪ সালে ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহ্-র বড়ো ছেলে হাফিজুল্লাহ্ অকালে মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল ঢাকাবাসী। তাঁর স্মৃতিরক্ষায় ইংরেজরা ভিক্টোরিয়া পার্কে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে। স্মৃতিস্তম্ভটির উদ্বোধন করা হয়েছিল ১৮৮৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্তি ঘটে। সেই উপলক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে শহিদ হওয়া দেশপ্রেমীদের সম্মান জানাতে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে এখানে এক বিশাল চারকোণা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। পার্কের নাম পাল্টে রাখা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।
মহাবিদ্রোহের সময়ে বিদ্রোহী যোদ্ধারা ঠিক করেছিলেন, ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতের শাসনভার তুলে দেওয়া হবে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের হাতে। সেই শেষ মুঘল সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই পার্কের এরকম নাম রাখা হয়েছিল।