এহসান গ্রুপে ৪০ লাখ টাকা রেখেছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা
এহসান গ্রুপে ৪০ লাখ টাকা রেখেছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা : হুজুরদের প্ররোচনায় নি:স্ব অনেকে।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, সহকারী শিক্ষক, বেসরকারি চাকরিজীবী, প্রবাসী এবং শ্রমজীবী কাউকে বাদ দেয়নি এহসান গ্রুপ।
এমনকি বিধবা ও গৃহিণীর টাকাও আত্মসাৎ করেছে তারা।
পরকালে মুক্তির দোহাই দিয়ে সুদবিহীন উচ্চ মুনাফার কথা বলে শুধুমাত্র যশোরের ১৬ হাজার মানুষকে নিঃস্ব করেছে। আত্মসাৎ করেছে ৩২২ কোটি টাকা।
এহসান গ্রæপের চেয়ারম্যান মুফতি মাওলানা রাগীব আহসান এসব টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
জীবনের শেষ সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া ১০ ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এই ১০ গ্রাহকের কাছ থেকে এহসান গ্রæপ হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন অসহায়ত্বের কথা।
ফেরত চেয়েছেন টাকা। শাস্তি চেয়েছেন রাগীব আহসান ও তার সহযোগীদের।
পরকালে মুক্তির দোহাই দিয়ে গ্রাহকদের বলা হয়েছিল, ব্যাংকে টাকা রাখা হারাম, এহসান গ্রæপে রাখা হালাল।
বেশির ভাগ গ্রাহককে মাসিক মুনাফা এবং অল্প কয়েকজনকে মেয়াদ পূর্তিতে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেয় সংস্থার মাঠকর্মী ও পরিচালকরা।
কিন্তু টাকা গ্রহণের পরপরই সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা গা ঢাকা দেয়। অফিস বন্ধ করে দেয়।
টাকা না পেয়ে ১০ গ্রাহকের মধ্যে একজন মারা গেছেন, শয্যাশায়ী হয়েছেন দুই জন। অভাব-অনটনের মধ্যে দিন পার করছেন অনেকে।
গচ্ছিত টাকা ফেরতের জন্য কয়েকজন মামলা করেছেন। অন্যরা একই পথে হাঁটছেন।
সাতক্ষীরায় ব্যাংকারকে মারধর করে জমি দখল
এই ১০ জনের মধ্যে বেশি টাকা গচ্ছিত রাখেন যশোর শহরের বেজপাড়া চোপদারপাড়া এলাকার কাজী মফিজুল হক (৭৮)।
তিনি পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, অবসর গ্রহণের পর পবিত্র হজ্ব করি। হজ্ব শেষে দেশে ফেরার পর শহরের দড়াটানা জামে মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাই।
সেখানকার ইমাম-মুয়াজ্জিন আমাকে জানান, ব্যাংকে টাকা রাখা হারাম। পরকালে জবাবদিহি করা লাগবে।
তারা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হন, এহসান গ্রæপে টাকা রাখলে হালাল হবে। এ ছাড়া ব্যাংকের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ পাওয়া যাবে।
তাই অবসরকালীন যে টাকা পাই, সেখান থেকে চার দফায় ৪০ লাখ দিই। প্রথমে ২০ লাখ, এরপর পাঁচ লাখ করে দুবার এবং শেষে ১০ লাখ টাকা দিই।
মাসিক লাখে ১৫০০ টাকা মুনাফা ৪-৫ মাস পাই। এরপর লভ্যাংশ দূরে থাক মূল টাকাও পাইনি। টাকা উদ্ধারে আদালতে মামলা করেছি।
চোপদারপাড়া এলাকার বিধবা জুলেখা বেগম (৬৮)। তিনি গচ্ছিত রাখেন প্রায় ১৬ লাখ টাকা। টাকা জমা দেওয়ার কিছু রশিদ হারিয়ে গেছে।
এহসান গ্রুপে ৪০ লাখ তবে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার রশিদ আছে তার কাছে।
তিনি বলেন, স্থানীয় জামে মসজিদের হুজুর ইমদাদের মাধ্যমে এহসান গ্রুপের নাম শুনি। ইমদাদের মাধ্যমেই এহসান গ্রæপে টাকা রাখি।
এর আগে সমিতির নিয়মে ৫০-১০০ টাকার কিস্তি চালাতাম। সেখান থেকে একবার ১৮ হাজার টাকা উত্তোলন করি।
এভাবে বিশ্বাস হয়। আমি ছাড়াও এলাকার অনেক মানুষ এহসান গ্রæপে টাকা জমা রাখতো।
আলেম-ওলামার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণে আমরা অনেক কষ্টের টাকা সেখানে জমা রেখেছি। বছর খানেক লভ্যাংশ পেয়েছি।
লভ্যাংশ এবং মূল টাকা ফেরত না পেয়ে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ১৮ জনকে আসামি করে মামলা করি।
পাবনার বেড়া উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান বাড়িতে গুলিবর্ষণ
শহরের রামকৃষ্ণ রোড এলাকার বাসিন্দা মুস্তফা দ্বীন মোহাম্মদ (৭৮)। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
এহসান গ্রুপের অন্যতম পরিচালক মুফতি আতাউল্লাহ তাকে এই খাতে টাকা বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন।
মুস্তফা ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা রাখেন। কিন্তু এক টাকাও ফেরত পাননি। আতাউল্লাহর বাবা ছিলেন মুস্তফার শিক্ষাগুরু।
মুফতি আতাউল্লাহর চাচাতো ভাই মাওলানা জোনায়েদ ও আইয়ুবও তার পরিচিত এবং টাকা রাখতে তারা প্ররোচনা দেন।
ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এতদিন মামলা করেননি। কিন্তু স¤প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের গ্রেফতার দেখে তিনিও মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন।
শহরের বাড়ি বিক্রি করে ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন রহিমা বেগম (৭০)।
একেবারে নিঃস্ব রহিমা এখন শহরতলীর ঝুমঝুমপুর ময়লাখানা এলাকার ভাঙা ঘরে বসবাস করেন। ইতোমধ্যে দুই দফা স্ট্রোক করেছেন।
সারাদিন শুয়েই থাকেন। এক ছেলে দিনমজুর, প্রায়ই কাজ থাকে না তার। রহিমা মাঝে মধ্যে ভিক্ষাও করেন। তিনি তার কষ্টের টাকাগুলো ফেরত চেয়েছেন।
যশোর শহরের শংকরপুরে ভিটাবাড়ির আট শতক জমি বিক্রির ১২ লাখ টাকা এবং নিজের জমানো এক লাখ ২৫ হাজার টাকাসহ
১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা এহসান গ্রæপে রাখেন আফসার উদ্দিন (৬৭)।
২০১৩ সালের জুলাই মাসে টাকা জমা রাখার পর ছয় মাস মুনাফা পান। এরপর গচ্ছিত টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে টালবাহানা শুরু করে প্রতিষ্ঠান।
এহসান গ্রুপে ৪০ লাখ তিনি টাকা আদায়ে মামলা করার জন্য একজনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছেন।
রাজশাহীতে উচ্ছেদ অভিযানে দিশেহারা প্রতিবন্ধীর পরিবার
সবেদা বেগম (৫৫) নামে এক নারী জাকির হোসেন নামে এক হুজুরের প্ররোচনায় এহসান গ্রুপে জমা দেন ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
তার বাড়ি শহরের রাজা বরদাকান্ত রোড এলাকায়। ২০১৪ সালে যখন জানতে পারেন টাকা-পয়সা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে,
তখন জাকির তাকে টাকা ফেরত দেবেন মর্মে জমা রশিদ ও বই নিয়ে যান। কিন্তু টাকা ফেরত দেননি। তখন থেকে জাকির লাপাত্তা।
টাকা আদায়ে তিনি আইনি পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন।
শহরের ইসমাইল কলোনি এলাকার বাসিন্দা লেবু বেগম (৬০) জমা দেন আট লাখ টাকা।
তিনি বলেন, মাঠকর্মী জাকির ও তার স্ত্রীর প্ররোচনায় এহসানে আট লাখ টাকা জমা রাখি। যে মাসে টাকা রেখেছিলাম, পরের মাসেই তারা লাপাত্তা।
এক টাকাও ফেরত পাইনি। নিজের ও ছেলের নামে টাকাগুলো জমা করেছি। আমি টাকা ফেরত চাই।
চাঁচড়া রায়পাড়া এলাকার আম্বিয়া বেগম (৬৮) জমা দেন ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, আমার কষ্টের টাকা এহসানে রেখেছি। আমি টাকাগুলো ফেরত চাই।
শহরের পুরাতন কসবা বিমান বন্দর রোড এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শামসুর রহমান (৫২) তার জমি বিক্রির ১৫ লাখ টাকা এহসানে রাখেন।
তিনি বলেন, বিমান বন্দর রোডের কুন্দিয়ানে জামে মসজিদের ইমাম, শহরের নীলগঞ্জ তাঁতিপাড়া এলাকার বাসিন্দা
ওমর ফারুকের প্ররোচনায় প্রথমে ১০ লাখ এবং পরে আরও পাঁচ লাখ গচ্ছিত রাখি। আমাকে বলা হয়,
লাখে প্রতিমাসে ১২০০ টাকা মুনাফা দেওয়া হবে। ৮-৯ মাস নিয়মিত লভ্যাংশ পেয়েছি। এরপর আর পাইনি।
জমি বিক্রির টাকা প্রথমে সোনালী ব্যাংকে রেখেছিলাম। ওই ইমাম কীভাবে জানতে পারেন আমার কাছে টাকা আছে।
যশোরে সোনার বারসহ আটক ব্যক্তির ১৪ বছর দন্ড
ইসলামের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এহসানে গচ্ছিত রাখতে বাধ্য করেন। আমার সবশেষ। এ ঘটনায় আমি মামলা করবো।
সদরের চাঁচড়া মধ্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত মাসুদুর রহমান বাবু (৪৭) রাখেন আট লাখ টাকা।
তিনি বলেন, দুই কিস্তিতে আট লাখ টাকা দিই। আমাকে বলা হয়েছিল, লাখে প্রতিমাসে ১৩০০ টাকা মুনাফা দেওয়া হবে।
মুফতি আতাউল্লাহ আমাকে এই হিসাবে টাকা জমা দিতে প্ররোচিত করেন।
তার অপর সঙ্গী মুফতি মো. ইউনুসের সঙ্গে পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা পাত্তা দেয়নি।
এখন টাকা আদায়ের জন্য আমি মামলা করবো। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আফসার উদ্দিন ও রহিমা বেগম বর্তমানে শয্যাশায়ী।
এ ছাড়া টাকার চিন্তায় স্ট্রোক করে মারা যান আম্বিয়া বেগমের স্বামী।
ধর্মের দোহাই দিয়ে মসজিদের ইমাম ও খাদেমদের একটি অংশ এহসান গ্রæপে বিনিয়োগের জন্য গ্রাহক তৈরি করতেন।
যশোরের প্রায় ১৬ হাজার গ্রাহকের ৩২২ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয় তারা।
হাজার হাজার গ্রাহক এহসান গ্রæপের প্রতারণায় জীবনের সব সঞ্চয় হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

প্রতিনিধির তালিকা দেখতে ভিজিট করুন shopnotelevision.wix.com/reporters সাইটে।




Pingback: শার্শায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ব্যবসায়ীর মৃত্যু - দ্যা বাংলা ওয়াল